মোঃ হাফিজুর রহমান হাফেজ, সাতক্ষীরা জেলা ক্রাইম রিপোর্টার।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে দালালি, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, মোটরসাইকেল চুরি, ডাকাতি এবং ভারত সীমান্তবর্তী উকশা, বসন্তপুর, মৌখালী ও বাসছাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ মালামাল চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে মো. হাফিজুর রহমান ওরফে টেমি হাফিজের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় দায়ের করা একাধিক মামলায় তিনি ডজনখানেক মামলার আসামি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয়দের দাবি, অভিযুক্ত মো. হাফিজুর রহমান পিতা: মৃত এলাই বক্স গাজী চাম্পাফুল ইউনিয়নের মশরকাটি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কালিগঞ্জ বাজার গ্রাম এলাকায় ভাড়াবাসায় বসবাস করছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে তিনি তার ছেলে তানভীরের মাধ্যমে উপজেলা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে ইয়াবা ও গাঁজা সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত।
প্রতিনিধি ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, হাফিজ মৃত এলাই বক্স গাজীর তিন পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ। পিতার জীবদ্দশায় তার মাদকাসক্তি, বেপরোয়া ও বেহিসেবি জীবনযাপন, একাধিক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক এবং সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে পারিবারিক অশান্তি তৈরি হয়। একপর্যায়ে এসব কারণে পিতা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে তিনি কালিগঞ্জের ফুলতলা এলাকায় ভাড়াবাসায় বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে সেটেলমেন্ট দালালি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এক সময় ভাড়াবাড়িতে এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে আটক করে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। ওই ঘটনার পর থেকেই এলাকায় তিনি ‘টেমি’ নামে পরিচিত হন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসা পরিবর্তন করে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করলেও তিনি আবারও মাদক কারবার, দালালি ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। কখনো সাংবাদিক, কখনো ডিজিএফআই পরিচয় ব্যবহার করে কালিগঞ্জের সরকারি দপ্তর, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মাদক বা তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের আটক করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেন বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালে একটি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে ফেনসিডিল ভর্তি একটি মাইক্রোবাসসহ ধরা পড়লেও নানা তদবিরে তিনি সে সময় রক্ষা পান। আরও অভিযোগ রয়েছে, তার স্ত্রী ও কন্যা এলাকায় উঠতি বয়সী যুবকদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। নিয়মিত তাদের বাসায় যুবকদের নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ইয়াবা সেবনের আসর বসানো হতো বলে এলাকাবাসী ও বাড়ির মালিকরা অভিযোগ করেন। এসব ঘটনায় একাধিকবার ভাড়াবাড়ি থেকেও তাদের বিতাড়িত করা হয়।
স্থানীয়দের আরও দাবি, টেমি হাফিজ নিজেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে থানা দালালি, পুলিশ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি, মানহানি ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও মাদকসহ এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে, যার কয়েকটি বিচারাধীন। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা তার অপকর্মে নেপথ্যে সহযোগিতা করে আসছেন।
এছাড়া অভিযোগে বলা হয়, ২০১৩ সালে হাফিজ ও তার সহযোগী হাবিব সাংবাদিক পরিচয়ে ফুলতলা মোড়ে জামায়াত-বিএনপির একটি বিক্ষোভ মিছিলে ছবি তুলতে গেলে বিক্ষোভকারীদের হাতে মারধরের শিকার হন। পরে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা জামায়াত-বিএনপির বহু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
স্থানীয় সূত্রে দাবি করা হয়, এসব মামলাকে পুঁজি করে তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ, ছবি এবং ১২টি ইউনিয়নের জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী, অর্থদাতা ও সমর্থকদের নামের তালিকা দেখিয়ে গ্রেপ্তার করানো এবং পরে ছাড়িয়ে দেওয়ার নামে অর্থ আদায় করা হতো। এ সংক্রান্ত কিছু প্রমাণ ভুক্তভোগীদের কাছে রয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সচেতন নাগরিক বা সংবাদকর্মী টেমি হাফিজের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাদের বিরুদ্ধেও মিথ্যা মামলা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ ও নানাভাবে হয়রানি করা হয়। ফলে তার কথিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই।
সম্প্রতি কালিগঞ্জের মধুসূদন কর্মকারের বাড়িতে সংঘটিত একটি ডাকাতির ঘটনায় পুলিশ তদন্তকালে মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে টেমি হাফিজের সিন্ডিকেট সদস্য মাছুমের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়। পরে তাকে সাতক্ষীরা শহরের ভাড়াবাসা এলাকা থেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ডাকাতির স্বর্ণ শ্যামনগরে বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়। এ ঘটনায় মাছুরকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে টেমি হাফিজ তার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য, মাদক, ব্ল্যাকমেইল ও ডাকাতিসহ পাঁচ মামলার আসামি মাক্ষি রানী মাছুরাকে দিয়ে ভিত্তিহীন বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই ভিডিওতে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার, কালিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)-এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।
এদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সংবাদকর্মীরা জানান, টেমি হাফিজের মাদক সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে পরপাজপুর এলাকার মন্টুর ছেলে মাদক ব্যবসায়ী মিয়ারাজ ও সিরাজের নাম উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, পূর্বের চাঁদার টাকা না দেওয়া এবং মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসনকে তথ্য দেওয়ায় সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী এস. এম. নাসির উদ্দিনকে নাজিমগঞ্জ যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল আটকিয়ে মারধর করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
ঘটনার পর থানায় এজাহার দায়ের করা হলে পাল্টা হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্তে অভিযোগকারী ও কয়েকজন সাক্ষীর মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সচেতন মহল ও নাগরিক সমাজ দ্রুত নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।